রাজশাহী বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য
রাজশাহী বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের শতবর্ষীয় প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রাজশাহী শহর, যা ব্রিটিশ আমল থেকেই "শিক্ষানগরী নামে পরিচিত, এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী শিক্ষার পথিকৃৎ হিসেবে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের সহায়তায় বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি এবং ইংরেজ কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে রাজশাহী শহরের বেসরকারি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। এটিই ছিল রাজশাহী নগরীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রথম ভিত্তি। তৎকালীন সমাজে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯২৫ সালে খান বাহাদুর এমাদুদ্দীন আহম্মদ, বশির উদ্দিন আহম্মেদ, মরহুম পারভেজ আলী, মুন্সি নসিম উদ্দিন আহম্মেদ ও মৌলভি আবু মোহাম্মদ হাসান এর ব্যক্তিগত উদ্যোগে হেতেম খাঁ মহল্লার মোহামেডান এসোসিয়েশন ভবনে একটি জুনিয়র মহিলা মাদ্রাসা চালু হয়। এই মাদ্রাসাটি ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত "রাজশাহী জুনিয়র গার্লস মাদ্রাসা" নামে পরিচিত ছিল।
১৯৫৭ সালের ১৫ জানুয়ারি, প্রতিষ্ঠানটি "রাজশাহী বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়" নামে নতুন পরিচিতি লাভ করে। এই সময় থেকে এটি শুধু মুসলিম মেয়েদের জন্য নয়, বরং সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। খান বাহাদুর এমাদুদ্দীন আহমেদ ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সভাপতি। বিদ্যালয়ের অবৈতনিক প্রধান শিক্ষক হিসেবে সারাজীবন শ্রম দিয়ে গেছেন মরহুম বশির উদ্দীন আহমেদ।
প্রতিষ্ঠান পরিসর ও বর্তমান অবস্থা: বিদ্যালয়টি বর্তমানে রাজশাহী শহরের কেন্দ্রস্থলে প্রায় এক একর জমির ওপর অবস্থিত। একটি চারতলা ভবন ও তিনটি বৃহৎ দ্বিতল ভবনের সমন্বয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রাঙ্গণে রয়েছে সবুজ খেলার মাঠ এবং সুসজ্জিত অডিটোরিয়াম। পুরো বিদ্যালয় চত্বর প্রায় ১০০০ বর্গফুটের সুরক্ষিত সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ১৫০০ ছাত্রী পড়াশোনা করছে।
এই বিদ্যালয় থেকে বহু কৃতী ছাত্রী ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্বদানকারী অসংখ্য কৃতী ব্যক্তিত্ব এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাদের প্রচেষ্টা ও অবদানের মধ্য দিয়ে বিদ্যালয়টি একটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক মাইলফলকে পরিণত হয়েছে। খেলাধুলায় বিদ্যালয়টি দেশ ও বিদেশে অনেক সুনাম অর্জন করেছে। ভলিবল, কাবাডি ও হকি সহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিদ্যালয়টি অনেকবার জাতীয় পর্যায়ে চাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিদ্যালয়টি সর্বদাই অগ্রসরমান। খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী রিজিয়া পারভীন এবং শারমিন সুলতানা ছন্দা এ বিদ্যালয়েরই গর্ব। বিদ্যালয়ের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি ছাড়াও জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে গার্লসগাইড, হলদে পাখি, রেডক্রিসেন্ট ইত্যাদি বিভাগগুলোর সযত্ন লালনে অব্যাহত প্রচেষ্টা চলছে।
রাজশাহী বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এটি রাজশাহীর ঐতিহ্য ও নারী শিক্ষার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বিদ্যোৎসাহীদের ত্যাগ, সাহস এবং নিরলস প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান এক শতাব্দী ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটি আজও শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে তার ঐতিহ্যকে ধারণ করছে।
মোঃ আনিছুর রহমান
রাজশাহী বহুমুখী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়